দি অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য স্পেকলড ব্যান্ড 

পর্ব ১ঃ

শার্লক হোমস মামলা হাতে নিত বেছে। উদ্ভট, অদ্ভুত, ফ্যানটাসটিক রহস্য না-হলে টাকার প্রলোভনেও আজেবাজে কেসে নাক গলাত না। ও ভালোবাসত জটিল ধাঁধার সমাধান করতে এবং ভালোবাসার টানেই দেখেছি গত আট বছরে সত্তরটি অত্যদ্ভুদ মামলার সমাধান করেছে। এর প্রতিটিতে ওর সান্নিধ্যলাভের সুযোগ আমি পেয়েছি, ওর আশ্চর্য তদন্ত পদ্ধতি লক্ষ করেছি। এইসবের মধ্যে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর কেস হল স্টোকমোরানের নামকরা ফ্যামিলি রয়লটদের ব্যাপারটা। ১৮৮৩ সালে এপ্রিল তখন সবে শুরু হয়েছে। সাতসকালে ঘুম ভেঙে গেল। অবাক হয়ে দেখলাম, আমাকে ঠেলে তুলেছে শার্লক হোমস স্বয়ং। অথচ চিরকালই বেলা পর্যন্ত ঘুমোনো ওর অভ্যেস।
‘ওয়াটসন,মক্কেল এসেছেন।তরুণী মক্কেল। এত সকালে যখন বাড়িসুদ্ধ সবাইকে জাগিয়েছেন, তখন বুঝতে হবে কেসটা ইন্টারেস্টিং। তোমাকে তাই না-ডেকে পারলাম না।’
'আরে ভাই, ভালোই করেছ। এ-সুযোগ কেউ ছাড়ে।
আশ্চর্য বিশ্লেষণী শক্তি আর যুক্তির খেলা দেখিয়ে হোমস যেভাবে রহস্য সমাধান করে, তা চিরকালই আমার কাছে একটা গভীর আনন্দের ব্যাপার। তাই চটপট সেজেগুজে নিয়ে গেলাম বসবার ঘরে। আমাদের দেখেই উঠে দাঁড়ালেন একজন মহিলা। মুখটা কালো ওড়নায় ঢাকা।
প্রসন্ন কন্ঠে হোমস বললে, ‘আমার নাম শার্লক হোমস। ইনি আমার প্রাণের বন্ধু ড. ওয়াটসন— সহযোগীও বটে। এর সামনেই সব কথা বলতে পারেন। আপনি বরং আগুনের পাশে বসুন। শীতে কাঁপছেন দেখছি।’
‘শীতে নয়, মি. হোমস আমি ভয়ে কঁপিছি, বলে মুখ থেকে ওড়না সরালেন মেয়েটি। দেখলাম, সত্যিই উদবেগ আতঙ্কে মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে, চোখে ভয়তরাসে চাহনি। বয়স তিরিশের নীচে। অকালে চুল পেকেছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পিচ্ছিল চাহনি বুলিয়ে নিয়ে হোমস অভয় দিয়ে বলল, ভয় কী? সব ঠিক হয়ে যাবে। সকালের ট্রেনে এলেন?
‘হ্যাঁ। আপনি তাহলে চেনেন আমাকে?”
‘না, চিনি না, তবে রিটার্ন টিকিটটা দস্তানায় গুজে রেখেছেন দেখা যাচ্ছে। বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন কাক-ডাকা ভোরে। এক ঘোড়ায় টানা হালকা গাড়িতে স্টেশনে পৌছেছেন। রাস্তা অনেকখানি এবং খুবই খারাপ। ভদ্রমহিলা হতভম্ব হয়ে গেলেন।
মৃদু হাসল হোমস, ‘জামার সাত জায়গায় কাদা লাগিয়ে এসেছেন। এক ঘোড়ায় টানা গাড়িতে কোচোয়ানের বাঁ-পাশে বসলে তবে ওইভাবে কাদা ছিটকে লাগে গায়ে।’
‘ধরেছেন ঠিক। সত্যিই বাড়ি থেকে বেরিয়েছি ছ’টার আগে। মি. হোমস, এ অবস্থা বেশিদিন চললে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাব আমি। আপনি আমাকে বাঁচান। এই মুহুর্তে আপনাকে টাকাকড়ি দিতে পারব না— কিন্তু দু-এক মাসের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যাবে আমার। আমার টাকা তখন আমারই হাতে আসবে। আপনার পাওনা আমি মিটিয়ে দেব।’
‘আপনার সমস্যাটা বলুন।'
সমস্যাটা সৃষ্টি হয়েছে কতকগুলো ধোয়াটে ব্যাপারের জন্যে। ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছি। একমাত্র একজনই আমাকে উচিত পরামর্শ দিতে পারেন এ-পরিস্থিতিতে— কিন্তু তিনিও খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেন না। ভাবছেন সবটাই মনগড়া ব্যাপার— ভয় পেয়ে উলটোপালটা ভাবছি। মেয়েলি কল্পনা। আপনার কাছে ছুটে এসেছি সেই কারণেই।’
‘বেশ তো বলুন না।’
‘আমার নাম হেলেন স্টোনার। স্টোকমোরানের রয়লট ফ্যামিলির শেষ বংশধর আমার সৎ-বাবা। এককালে এ-বংশের প্রতাপ ছিল, টাকার জোর ছিল— এখন দু-শো বছরের বাড়িটা আর কয়েক একর জমি ছাড়া কিছু নেই। ‘আমার সৎ-বাবা এই বংশের শেষ পুরুষ। উনি ভাগ্য ফেরানোর জন্যে কলকাতায় যান, ডাক্তারি করে যথেষ্ট রোজগার করেন। তারপর একদিন রাগের মাথায় খাস চাকরকে মারতে মারতে একদম মেরে ফেলায় কোনোমতে ফাঁসির দড়ি থেকে বেঁচে যান, কিন্তু জেল খাটতে হয় অনেক দিন। জেল থেকে বেরিয়ে চলে আসেন ইংলন্ডে।
‘বেঙ্গল আর্টিলারির মেজর স্টোনার আমার বাবা। আমরা দুই বোন— জুলিয়া আর আমি— যমজ। উনি মারা যাওয়ার পর আমাদের বয়স যখন মাত্র দু-বছর, মা বিয়ে করে ডা. রয়লটকে। বিয়েটা হয় ভারতবর্ষে।
‘মায়ের যা টাকা ছিল, তা থেকে বছরে হাজার পাউন্ড আয় হত। সৎ-বাবাকে মা সব টাকাই উইল করে দিয়েছিলেন একটা শর্তে। আমাদের বিয়ের পর কিছু টাকা দুই বোনকে দিতে হবে’। ইংলন্ডে ফিরে আসার পর আট বছর আগে ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে মা মারা যায়। লন্ডনে প্র্যাকটিস করবেন ভাবছিলেন সৎ-বাবা, এই ঘটনার পর তিনি আর সেসবের মধ্যে গেলেন না। স্টোকমোরানে বাপ-ঠাকুরদার ভিটেতে ফিরে এলেন।
‘প্রতিবেশীরা তখন খুব খুশি হয়েছিল। কিন্তু দু-দিন যেতে-না-যেতেই তারা সৎ-বাবার ছায়া মাড়ানোও ছেড়ে দিল। কারণ তার বদমেজাজ। বাড়ি থেকে বেরোতেন না, কারো সঙ্গে মিশতেন না। বংশের আদিপুরুষের মতো এমনিতেই রগচটা ছিলেন– অনেকদিন গরমের দেশে থাকার ফলে মেজাজ আরও তিরিক্ষে হয়ে গিয়েছিল। কয়েকটা ঝামেলা পুলিশ কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। এই সেদিন গাঁয়ের কামারকে পাঁচিলের ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন নদীর জলে। গায়ে তার আসুরিক শক্তি। মেলামেশা করেন যাযাবর বেদেদের সঙ্গে। নিজের কাঁটা জমিতে তাদের থাকতে দেন। নিজেও মাঝে মাঝে তাদের তাবুতে গিয়ে থাকেন— ওদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান। ভারতবর্ষের জন্তুজানোয়ার পুষতে ভালোবাসেন। একটা চিতাবাঘ আর একটা বেবুন তো নিজের বাগানেই ছেড়ে রাখেন— তল্লাটের কেউই তাই আমাদের ত্রিসীমানায় আসতে চায় না। কোনো চাকরবাকরও বাড়িতে থাকতে চায় না। আমরা দুই বোন সব কাজ করেছি। জুলিয়া মারা যায় তিরিশ বছর বয়সে। আমার মতন তারও চুলে পাক ধরেছিল মৃত্যুকালে।
বোন মারা গেছেন?
‘দু-বছর আগে। বুঝতেই পারছেন, এ অবস্থায় কেউই আমরা সুখে ছিলাম না। কোথাও বেরোতে পারতাম না— মাসির কাছে যাওয়া ছাড়া। মাসি বিয়ে-থা করেনি— থাকত হ্যারোতে। সেইখানেই গিয়ে থাকতাম মাঝে মাঝে। দু-বছর আগে বড়োদিনের সময়ে সেখানেই নৌদপ্তরে এক আধা মাইনের রিটায়ার্ড মেজরের সঙ্গে জুলিয়ার বিয়ে ঠিক হয়। স্টোকমোরানে ফিরে আসার পর সৎ-বাবা বিয়ের কথা শুনলেও কোনো আপত্তি করেননি। দিন কয়েক পরেই মানে, বিয়ের ঠিক পনেরো দিন আগে, একটা লোমহর্ষক ঘটনা ঘটল। মারা গেল জুলিয়া।
এতক্ষণ চোখ মুদে শুনছিল হোমস। এবার অর্ধনিমীলিত চোখে বললে, “সমস্ত বলবেন— কিছু বাদ দেবেন না।’
‘নিশ্চয় বলব। সেই ভয়ংকর রাতের কোনো কথাই এ-জীবনে আর ভুলতে পারব না।
স্টোকমোরানের জমিদার ভবন দু-শো বছরের পুরোনো। পোড়োবাড়ির অবস্থায় পৌছেছে। একটা অংশে কোনোমতে থাকা যায়। শোবার ঘরগুলো একতলায়। একটা বারান্দার পাশে পাশাপাশি তিনটে শোবার ঘর। তিনটে ঘরেরই জানলার পাশে ঘাস-ছাওয়া লন। প্রথম ঘরটা সৎ-বাবার, দ্বিতীয়টা জুলিয়ার, তৃতীয়টা আমার। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়ার দরজা নেই– কিন্তু সব ঘরের দরজা আছে একই বারান্দার। বসবার ঘরটা বাড়ির মাঝের অংশে। ‘ভয়ংকর সেই রাতে সৎ-বাবা একটু তাড়াতাড়ি শুতে গেলেন। ঘরে গিয়ে কড়া চুরুট খেতে লাগলেন। ভারতীয় চুরুট। নিজের ঘরে বসে সেই গন্ধে তিষ্ঠোতে না-পেরে জুলিয়া এল আমার ঘরে। আসন্ন বিয়ে সম্বন্ধে একটু গল্পগুজব করার পর এগারোটা নাগাদ উঠে দাঁড়াল নিজের ঘরে যাবে বলে। তারপর বললে, ‘হেলেন, তুই কি রাতে শিস দিস?
আমি বললাম, ‘না তো।” 
ও বলল, কিন্তু রোজ রাতে শিসের আওয়াজ শুনছি ক-দিন। আমি ভাবলাম তুই বুঝি ঘুমিয়ে শিস দেওয়া আরম্ভ করেছিস।
আমি বললাম, ‘দুর আমি কেন দেব। ওই পাজি বেদেগুলোর কাণ্ড নিশ্চয়।
ও বলল, ‘তাহলে তো তুইও শুনতে পেতিস। লন থেকে শিস দিলে তোর কানেও যাওয়া উচিত।’
আমি বললাম, ‘তোর মতন পাতলা ঘুম তো নয় আমার।
‘জুলিয়া তখন চলে গেল নিজের ঘরে। ভেতর থেকে দরজায় তালা দেওয়ার আওয়াজ পেলাম।’
শার্লক হোমস বললে,‘রোজ রাতে দরজায় তালা দেন নাকি?’
দিই। বাগানে চিতাবাঘ আর বেবুন ছাড়া থাকে বললাম না? দরজায় তালা না-দিলে নিশ্চিন্ত হতে পারি না।’
‘তারপর?’
ঘটনাটা ঘটল সেই রাতেই। জানেন তো যমজদের আত্মা সূক্ষ্ম যোগসূত্রে বাঁধা থাকে। তাই আসন্ন দুর্ভাগ্যের সম্ভাবনায় ঘুমোতে পারছিলাম না কিছুতেই। অজানা আতঙ্কে কাঠ হয়ে ছিলাম বিছানায়। বাইরে ঝড়ের হুংকার, জানলায় বৃষ্টির ঝাপটা শুনছি আর শুনছি। আচমকা ঝড়বাদলার এই মাতামতির মধ্যেই শুনলাম নারীকণ্ঠের একটা ভয়ার্ত চিৎকার। বিষম আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠেছে আমার বোন— গলা শুনেই বুঝলাম। তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে গায়ে শাল জড়িয়ে ছুটে গেলাম করিডরে। দরজা যখন খুলছি, তখন যেন একটা চাপা শিসের শব্দ কানে ভেসে এল। ঠিক যেমনটি আমার বোন বলেছিল— অবিকল সেইরকম। তার কয়েক মুহুর্ত পরেই ঝন ঝন ঝনাৎ করে আওয়াজ কানে ভেসে এল। যেন ধাতুর কিছু পড়ে গেল। করিডর দিয়ে ছুটতে ছুটতে দেখলাম আস্তে আস্তে কবজার ওপর ঘুরে যাচ্ছে বোনের ঘরের দরজা। আতঙ্কে কাঠ হয়ে চাইলাম সেইদিকে— না-জানি কী জিনিস বেরিয়ে আসবে ঘর থেকে। বারান্দায় আলোয় কিন্তু দেখলাম, আমার বোনই বেরোচ্ছে ঘর থেকে, ভয়ে বিকট হয়ে গিয়েছে মুখ, দু-হাত সামনে বাড়িয়ে হাওয়া আঁকড়াবার চেষ্টা করছে, মাতালের মতো সারাশরীর দুলছে। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। ঠিক তখনই ওর হাটু আর ভার সইতে পারল না— লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। এমনভাবে পাকসাট খেতে লাগল যেন বিষম যন্ত্রণায় ছিড়ে যাচ্ছে শরীরটা। প্রথমে ভেবেছিলাম, আমাকে বুঝি চিনতেই পারছে না। তারপরেই আচমকা যন্ত্রণায় ভাঙা গলায় ভীষণ চিৎকার করে বললে, ‘হেলেন। হেলেন। ডোরাকাটা পটি। ফুটকি দাগওলা ডোরাকাটা সেই পটি। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, আঙুল তুলে ডাক্তারের ঘরের দরজাও দেখিয়েছিল— কিন্তু যন্ত্রণার নতুন তাড়সে সিটিয়ে যেতে মুখ দিয়ে কথা আর বেরোল না। আমি ছুটে গিয়ে তারস্বরে ডাকলাম সৎ-বাবাকে। ড্রেসিংগাউন গায়ে হস্তদন্ত হয়ে উনি বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। বোনের পাশে এসে যখন পৌছোলেন, তখন তার জ্ঞান নেই। তাড়াতাড়ি গলায় ব্র্যান্ডি ঢেলে দিলেন, গা থেকে ওষুধপত্তরের ব্যবস্থা করলেন— কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না— জুলিয়া আর জ্ঞান ফিরে পেল না। জীবনীশক্তি ক্ষীণ হয়ে এল একটু একটু করে— মারা গেল অজ্ঞান অবস্থাতেই। ভয়াবহভাবে শেষ হয়ে গেল আমার প্রাণপ্রিয় বোন।’ হোমস বাধা দিয়ে বললে, ‘এক সেকেন্ড। ধাতব আওয়াজ আর শিস দেওয়ার শব্দটা ঠিক শুনেছেন তো?’
‘জুলিয়ার পরনে পোশাক কী ছিল?’
‘শোয়ার পোশাক। বাঁ-হাতে দেশলাই, ডান হাতে একটা পোড়া কাঠি”।
গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। সর্বনাশের মুহুর্তে দেশলাই জ্বালিয়ে উনি দেখেছিলেন। করোনার কী বলেন?’
অনেক তদন্ত করেও তিনি মৃত্যুর সঠিক কারণ বার করতে পারেননি, ডা. রয়লটের বদনাম তো কম নয়। কুখ্যাত হয়ে গিয়েছেন গোটা তল্লাটে।
আমার সাক্ষ্য থেকে জানা গেছে, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, সেকেলে খড়খড়ি আর লোহার মোটা গরাদওলা জানলাও বন্ধ ছিল ভেতর থেকে। দেওয়াল নিরেট, মেঝেও নিরেট। চওড়া চিমনির মুখ চারটে শিক দিয়ে বন্ধ। সোজা কথায়, মারা যাওয়ার সময়ে জুলিয়া একলাই ছিল। তা ছাড়া ওর শরীরে জোরজবরদস্তিরও কোনো দাগ বা চিহ্ন পাওয়া যায়নি।’
‘বিষ দেওয়া হয়েছিল কি না দেখা হয়েছে?
‘ডাক্তাররা দেখেছেন– বিষ পাননি।’
‘সাংঘাতিক ভয়ে স্নায়ুতে চোট পেয়ে গেছে বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু ভয় পেল কেন, সেইটাই বুঝতে পারছি না।
‘জিপসিরা কি তখন বাগানেই ছিল?
‘সবসময়েই তো থাকে— তখনও ছিল জনাকয়েক।’
‘ডোরাকাটা ফুটকি দাগওয়ালা পটিটা কী হতে পারে?
‘জিপসিরা অনেকে ওইরকম রুমাল মাথায় বাঁধে। হয়তো প্রলাপ বকেছে।’
হোমসের মাথা নাড়া দেখে বুঝলাম খুশি হতে পারেনি জবাব শুনে।
বলল, ‘খুবই গভীর জলের ব্যাপার। যাকগে, আপনি বলে যান।’
‘একা একা কাটল দুটো বছর। মাসখানেক আগে আমারও বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেল। সৎ-বাবা কোনো আপত্তি করেননি। দিন দুয়েক আগে বাড়ির পশ্চিম দিকে মেরামতির কাজ আরম্ভ হল, আমার শোবার ঘরের দেওয়াল ফুটো করা হল। বাধ্য হয়ে বোনের ঘরে এসে শুলাম রাতে— বোনেরই খাটে শুতে হল নিরুপায় হয়ে। আমার মানসিক অবস্থা তখন কীরকম অনুমান করে নিন। একদম ঘুমোতে পারছি না— কেবল এপাশ-ওপাশ করছি। গভীর রাতে আচমকা শুনলাম সেই শিসের শব্দ– যে-শিস শুনেছিলাম জুলিয়া মারা যাওয়ার রাতে। আঁতকে উঠে নেমে পড়লাম খাট থেকে। সারারাত জেগে কাটিয়ে দিলাম। ভোররাতে চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম— সোজা এসেছি আপনার কাছে।’
‘ভালোই করেছেন, বলল শার্লক হোমস, কিন্তু মিস স্টোনার, আপনি তো সব কথা খুলে বলেননি— সৎ-বাবার অনেক কীর্তিই আপনি চেপে গেছেন।”
বলেই, হেলেন স্টোনারের কবজির ওপর থেকে জামার কাপড় সরিয়ে দিল হোমস। দেখলাম, পাঁচ আঙুলের স্পষ্ট কালসিটের দাগ।
‘জানোয়ারের মতো ব্যবহার করা হয়েছে আপনার সঙ্গে, তাই না?’
লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেল মেয়েটির। তাড়াতাড়ি কবজি ঢেকে বললে :
‘গায়ে আসুরিক জোর তো— খেয়াল থাকে না।’
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তন্ময় হয়ে আগুনের দিকে চেয়ে রইল হোমস। তারপর বললে, ‘ব্যাপারটা খুবই রহস্যজনক। হাতে সময়ও বেশি নেই। আজই আপনাদের বাড়িটা পরীক্ষা করে দেখতে চাই– কিন্তু সৎ-বাবা যেন জানতে না-পারেন। সম্ভব হবে?
‘হ্যাঁ হবে। উনি আজকে শহরে আসবেন জানি।’
‘তাহলে ওই কথাই রইল। বিকেল নাগাদ আমরা দুই বন্ধু আপনার বাড়ি যাচ্ছি
পর্ব ২ঃ
মিস স্টোনার চলে যাওয়ার পর হোমস বললে, ‘ওয়াটসন, কী বুঝলে ?’
‘অকুল রহস্য। দিশে পাচ্ছি না। জুলিয়া মারা যাওয়ার সময়ে ঘরে তো কেউ ছিল না। তাহলে ?’
‘তাহলে মরবার সময়ে ডোরাকাটা ফুটকি দাগওলা পটির কথা বলে গেল কেন? কেনই-বা শিসের শব্দ শোনা যেত রাতে ?
‘আমার মাথায় আসছে না।’
‘ভায়া, ঘটনাগুলো পর পর সাজিয়েই দেখ না। প্রথমেই ধরে নাও সৎমেয়ের বিয়ে আটকালে ডাক্তারের অর্থিক লাভ হয়েছে। তারপরেই দেখ ভদ্রলোকের সঙ্গে জিপসিদের দহরম-মহরম এবং রাত্রে শিসের আওয়াজ। ডোরাকাটা পটির কথা বলেই মিস স্টোনারের জ্ঞান লোপ এবং একটা ঝন ঝন ঝনাৎ শব্দ— যা কিনা খড়খড়ি বন্ধ করার জন্যে লোহার খিল ফেলার আওয়াজ হতে পারে। সবকটা ঘটনা এক সুতোয় গাঁথলে রহস্য-সূত্র পাওয়া যাবেই। আরে! আরে! এ আবার কোন আপদ ?
দড়াম করে দরজা খুলে মূর্তিমান উৎপাতের মতো ঘরে ঢুকল দানবাকৃতি এক বৃদ্ধ। মাথার টুপি প্রায় দরজায় ঠেকেছে, এত লম্বা। নিশ্বাস ফেলছে ফোঁস ফোঁস করে। বলিরেখা আঁকা মুখটা হলুদ হয়ে এসেছে রোদে পুড়ে। মুখের পরতে পরতে অনেক দুষ্কর্ম প্রকট হয়ে রয়েছে। চোখ তো নয়— যেন আগুনের ভাটা— রাগে জ্বলছে। বাজপাখির মতো সরু খাড়া নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠেছে। সব মিলিয়ে যেন একটা প্রেতচ্ছায়া।
হাতের চাবুকটা নাড়তে নাড়তে ক্রুদ্ধ হুংকার ছেড়ে বললে আগন্তুক, শার্লক হোমস কোন জন?’
‘আমি, শান্তস্বরে বললে বন্ধুবর, আপনি?’
‘স্টোকমোরানের ডাক্তার গ্রাইমসবি রয়লট।’
‘বসুন।’
‘বসতে আসিনি। আমার সৎ-মেয়ে এখানে এসেছিল। কেন?’
‘বড়ো ঠান্ডা পড়েছে বাইরে।’
‘কী বলছিল?’ হিংস্র চিৎকার ছাড়ল বৃদ্ধ।
‘তাহলে ক্রুকাস ভালোই ফুটবে, নিরুত্তাপ স্বরে বলে গেল হোমস।
‘আচ্ছা! এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে? স্কাউন্ডেল কোথাকার! তোমাকে আমি চিনি, এগিয়ে এসে নাকের ডগায় চাবুক নাড়তে নাড়তে দাঁত কিড়মিড় করে উঠল বৃদ্ধ। পরের ব্যাপারে কাঠি দেওয়া তোমার স্বভাব?’
হাসল হোমস।
‘পরচর্চায় বড় আনন্দ, না?’
হোমসের হাসি সারামুখে ছড়িয়ে পড়ল।
‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লক্কা পায়রা কোথাকার!’
প্রাণ খুলে খুক খুক করে হেসে হোমস বললে, “আপনার কথায় বেশ মজা আছে। যাওয়ার সময়ে দরজাটা বন্ধ করে যাবেন— ঠান্ডা ঝাপটা আসছে।’
‘যা বলতে এসেছি, সেটা বলব, তারপর যাব। আমার ব্যাপারে নাক গলাতে এস না শার্লক হোমস। মিস স্টোনারের পেছন পেছন আমি এসেছি— আমি জানি এখানে সে এসেছিল! আমি কিন্তু লোক খুব খারাপ— ঘেটিয়ো না। দেখ তবে— বলেই আগুন খোঁচানোর লোহার ডান্ডাটা বিশাল বাদামি হাতে তুলে বেঁকিয়ে ফেলে দিল ফায়ারপ্লেসে।
‘আমার মুঠোয় পড়লে এই দশাই হবে বলে দিলাম। দংষ্ট্রাসহ জিঘাংসাকে প্রকট করে তুলে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অসুর আকৃতি।
ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে গেলে দেখিয়ে দিতাম কবজির জোরে আমিও কম যাই না,’ বলে ইস্পাতের ডান্ডাটা তুলে এক ঝটকায় ফের সিধে করে দিল আগের মতো।
‘লোকটার স্পর্ধা দেখ! আমাকে কিনা সরকারি ডিটেকটিভ বলে গাল পাড়ে! যাকগে, ভালোই হল। তদন্ত করার উৎসাহটা আরও বেড়ে গেল। মেয়েটার ওপর এখন অত্যাচার না-হলেই হয়। ওয়াটসন, প্রাতরাশ খেয়ে নেওয়া যাক। তারপর আমি বেরোব একটু খোঁজখবর নিতে ’
দুপুর একটা নাগাদ বাড়ি ফিরল হোমস। হাতে একতাড়া কাগজ। তাতে অনেক কিছু লিখে এনেছে।
বললে, ‘মিস স্টোনারের মা যে উইল করে গেছেন, তা দেখে এলাম। আগে এক বছরের আয় ছিল ১১০০ পাউন্ড। এখন ৭৫০ পাউন্ড। ১ বিয়ে হলে প্রত্যেক মেয়ে বছরে পাবে ২৫০ পাউন্ড। অর্থাৎ দুই মেয়েই পাত্রস্থ হলে ভদ্রলোকের ভাড়ে থাকে মা ভবানী। নাও হে ওয়াটসন, এবার ওঠো। সকালের কাজটা বৃথা যায়নি— এবার শুরু হোক বিকেলের কাজ। সঙ্গে রিভলভারটা নিয়ো। যে-লোক কথায় কথায় লোহার ডান্ডা বাঁকায়, তার সঙ্গে রিভলভার নিয়ে কথা বলাই ভালো।’ স্টোকমোরানে পৌছে দেখলাম মিস স্টোনার আমাদের জন্যেই বাড়ির বাইরে পায়চারি করছেন।
হোমসকে দেখেই সাগ্রহে বললে, ‘ডক্টর রয়লট লন্ডন গেছেন— ফিরতে সেই সন্ধে।”
‘জানি। দেখা হয়েছে আমাদের সঙ্গে,’ বলে ঘটনাটা বলল হোমস।
ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন মিস স্টোনার, ‘সাংঘাতিক ধড়িবাজ তো! পেছন নিয়েছিলেন ?’
অভয় দিয়ে হোমস বললে, ‘ঘাবড়াবেন না। ওঁর চাইতেও ধড়িবাজ লোক ওঁরই পেছনে এবার লেগেছে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আপনাকে মাসির কাছে রেখে আসব। চলুন, ঘরটা দেখে আসি।
সুপ্রাচীন প্রাসাদের প্রায় সবটাই পড়ো-পড়ো অবস্থায় পৌছেছে। একদিকে বাসোপযোগী একটা অংশে রাজমিস্ত্রির কাজ চলছে। ভারা বাঁধা। কিন্তু মিস্ত্রি নেই। একটা বারান্দার ওপর পাশাপাশি তিনটে ঘর। শেষের ঘরটায় দেওয়াল ভাঙা । হোমস সে-ঘরে গেলই না। যে-ঘরে মিস স্টোনার রাত কাটিয়েছেন, সেই ঘরের দিকটায় জানলার লেন্স দিয়ে পরীক্ষা করল অনেকক্ষণ। ভেতর থেকে হুড়কো দিয়ে খড়খড়ি আটকানোর পর বাইরে থেকে অনেক চেষ্টা করেও খুলতে পারল না। হোমস বললে, ‘মিস স্টোনার, আপনার শোবার ঘরটা মেরামত না-করলেই কি চলছিল না?’
‘কোনো দরকারই ছিল না। আমার তো মনে হয় ওই অছিলায় উনি আমাকে মাঝের ঘরে সরিয়েছেন।’
ঘরটা সাদাসিদে, বহু পুরোনো দেওয়াল, আসবাবপত্র মামুলি। দেওয়াল-ঘেঁষা একটা সরু খাট, সিন্দুক, ড্রেসিং টেবিল, চেয়ার। এক কোণে বসে তীক্ষ্ণ চোখে সব কিছুই যেন মনের পর্দায় একে নিতে লাগল হোমস।
বিছানার পাশে একটা দড়ি ঝুলছিল কড়িকাঠের কাছ থেকে। ঝুমকো প্রান্ত লুটিয়ে বালিশে।
হোমস বললে, দড়িটা কীসের ?’
‘ঘণ্টার। হাউসকিপারের ঘর পর্যন্ত গিয়েছে।’
‘এ-ঘরের সব কিছুই তো দেখছি পোকায় খাওয়া। দড়িটা সে তুলনায় অনেক নতুন মনে হচ্ছে।’
‘এই তো বছর দুই হল লাগানো হয়েছে।’
‘বোন বলেছিল বলে?’
‘না, না। জুলিয়া চায়নি। ঘণ্টা টেনে ফরমাশ করা আমাদের ধাতে নেই। কাজকর্ম নিজেরাই করি।’
‘দাঁড়ান, মেঝেটা দেখি, বলে আতশকাচ হাতে মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ল হোমস। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেঝে পর্যবেক্ষণ করল নিমগ্ন চিত্তে। মেঝের প্রত্যেকটা ফাটা, দেওয়ালের তক্তা তন্নতন্ন করে দেখার পর গেল খাটের কাছে। স্থির চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর চোখ বুলালো দেওয়ালের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত। সবশেষে ঘণ্টার দড়ি ধরে মারল টান।
টেনেই বললে, ‘আরে! এ তো দেখছি মেকি ব্যাপার!’
‘বাজছে না বুঝি?
‘বাজবে কী করে ? তারের সঙ্গে বাধা থাকলে তো! ইন্টারেস্টিং ব্যাপার দেখছি। নিজেই দেখুন না হাওয়া যাতায়াতের ঘুলঘুলির ঠিক ওপরে হুকের সঙ্গে বাধা রয়েছে দড়িটা।
এ কী অদ্ভুত ব্যাপার। লক্ষই করিনি এতোদিন।
অদ্ভুত বলে অদ্ভুত। আশ্চর্য ব্যাপার আরও আছে এ-ঘরে। যেমন ধরুন এমন বোকা রাজমিস্ত্রি কখনো দেখেছেন যে হাওয়া যাতায়াতের জন্যে পাশের ঘরের দেওয়ালে ঘুলঘুলি বানায়? একই মেহনতে খোলা বাতাস আনা যেত যদি ঘুলঘুলিটা বানানো হত বাইরের দেওয়ালে!’
‘ওটাও সম্প্রতি তৈরি।’
‘ঘণ্টার দড়ি যখন এসেছে, সেই সময়ে তো ?’
‘হ্যা। কিছু রদবদল করা হয়েছিল তখন।’
‘খুবই ইন্টারেস্টিং রদবদল, মিস স্টোনার। এক নম্বর, ডামিঘন্টার দড়ি— ধোঁকা দেওয়ার জন্যে। দু-নম্বর— এমন একটা ভেন্টিলেটর যা ভেন্টিলেটরের কাজ করে না।– এবার পাশের ঘর নিয়ে রিসার্চ করা যাক।’ ডা, গ্রাইমসবি রয়লটের ঘরখানা একটু বড়ো— কিন্তু আসবাবপত্র একইরকম সাদাসিদে। ক্যাম্পখাট, কাঠের তাকভরতি বই— বেশির ভাগই যন্ত্রশিল্প সম্পর্কিত, বিছানার পাশে একটা আর্মচেয়ার, দেওয়ালের পাশে একটা কাঠের মামুলি চেয়ার, একটা গোল টেবিল, একটা বড়ো লোহার সিন্দুক। চুলচেরা চোখে তন্ময় হয়ে প্রতিটি বস্তু দেখল হোমস।
সিন্দুকে আঙুল ঠুকে বলল, ‘কী আছে এতে?
‘সৎ-বাবার ব্যাবসার কাগজপত্র।”
‘ভেতর দেখেছেন ??
‘অনেক বছর আগে একবারই দেখেছি— কাগজ ঠাসা ছিল।’
‘ভারি অদ্ভুত কথা বলেন তো!’
ডালার ওপর এক ডিশ দুধ দেখিয়ে হোমস বললে, “এইজন্যে বললাম!'
বেড়াল নেই, তবে চিতা আর বেবুন আছে।
‘তা বটে। চিতা আছে– বেড়ালেরই জাত— কিন্তু দুধে তার রুচি নেই, বলতে বলতে কাঠের চেয়ারটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে চেয়ার পর্যবেক্ষণ মন প্রাণ ঢেলে দিলে হোমস।
উঠে দাঁড়িয়ে লেন্স পকেটে পুরে বললে, ‘থ্যাংকিউ! সব বোঝা গেছে। আরে! আরে! আবার একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার!”
যা দেখে তাজ্জব হল শার্লক হোমস তা একটা কুকুর-মারার ছোট্ট চাবুক। ঝুলছে বিছানার কোণে। ডগাটায় কিন্তু একটা ফাঁস।
ওয়াটসন, ‘কী বুঝলে?’
‘মামুলি চাবুক। কিন্তু ফাঁস বাধা কেন বুঝছি না।
ওইখানটায় কেবল মামুলি ঠেকছে না, কেমন? দুনিয়াটা বদমাশ লোকে বোঝাই হে, তার ওপর যদি চালাক লোক পাপ কাজে নামে তার মতো কুচক্রী আর হয় না। মিস স্টোনার, চলুন এবার, লনে যাওয়া যাক।’
মুখখানা অন্ধকার করে অনেকক্ষণ লনে পায়চারি করল বন্ধুবর। তারপর বললে, ‘মিস স্টোনার, আমি যা বলব, আপনাকে তাই করতে হবে।’
‘আপনার হাতেই তো ছেড়ে দিয়েছি নিজেকে।
‘তাহলে আজকে আপনি রাত কাটাবেন আপনার পুরোনো ঘরে। আর আমরা রাত কাটাবো আপনার ঘরে?
মিস স্টোনার আর আমি দুজনেই যুগপৎ অবাক হয়ে গেলাম।
হোমস বললে, ‘শিসের শব্দটা কী, আমি জানতে চাই।— ওইটা নিশ্চয় গায়ের সরাইখানা?
‘হ্যা।’
‘ওখান থেকে আপনার ঘরের জানলা দেখা যায়?”
‘যায়?’
‘তাহলে ডাক্তার ফিরে আসার পর মাথা ধরার অছিলায় আপনার ঘরে ঢুকে পড়বেন। যখন বুঝবেন উনি শুয়ে পড়েছেন, জানলা খুলে বাতিটা পাশে রাখবেন— যাতে সংকেত আলো দেখতে পাই। তারপর দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে আপনার পুরোনো ঘরে চলে যাবেন।
মিস স্টোনার হোমসের বাহু স্পর্শ করে বললে, “আমার বোন মারা গিয়েছে কেন, আপনি তা আঁচ করেছেন মনে হচ্ছে?”
‘করেছি।’
‘ভয় ?’
‘না। আরও স্পষ্ট হোক কারণটা, তারপর বলব।’
চলে এলাম সরাইখানায়। ওপরতলায় এমন একটা ঘর বেছে নিলাম যেখান থেকে জীর্ণ প্রাসাদে মিস স্টোনারের ঘর দেখা যায়। বৈঠকখানা ঘরে আলো জ্বলে উঠল ডাক্তার রয়লট ফিরে আসার পরেই। ভদ্রলোক যে ভয়ঙ্কর রেগে আছে তা দূর থেকেই বোঝা গেল। গেট খুলতে একটু দেরি করছিল গাড়োয়ান— তাতেই এই মারে কি সেই মারে ভাব দেখা গেল। সেইসঙ্গে বাজখাই চিৎকার।
অন্ধকারে ঘরের জানলায় বসে এইসব দেখছি, এমন সময়ে হোমস বললে, ‘ওয়াটসন, আজকের অভিযানে বিপদ আছে। তোমাকে নিয়ে যেতে মন চাইছে না।’
‘কীসের বিপদ? আমি যা দেখছি, তুমিও তা দেখেছ? তবে?
‘ভেন্টিলেটরটা দেখলে তো ?’
‘দুর! অত ছোটো ফুটাে দিয়ে ইদুর পর্যন্ত গলতে পারবে না।’
'ভায়া, এখানে আসার আগেই জানতাম ও-রকম একটা ফুটো আছে।’
‘মাই ডিয়ার হোমস !’
আরে, এটা বুঝছ না কেন, ফুটো না-থাকলে নিজের ঘরে বসে জুলিয়া পাশের ঘরে চুরুট খাওয়ার গন্ধ পেতেন কী করে?
‘কিন্তু তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল?’
‘ভেন্টিলেটর তৈরি হল, দড়ি ঝোলানো হল, বিছানায় শুয়ে একটি মেয়ে মারা গেল। তিনটে ঘটনার যোগসূত্র কি বিচিত্র নয়?
‘তিনটে ঘটনার মধ্যে আদৌ কোনো যোগসূত্র আছে বলেই মনে হয় না আমার। বিছানাটার বৈশিষ্ট্য দেখেছিলে?’
‘না তো।’
‘চারটে পায়াই মেঝেতে আঁটা। ইচ্ছে করলেও সরিয়ে শোয়া যায় না। ঘণ্টার মেকি দড়ির তলাতেই রাখতে হবে।’
‘হোমস! হোমস। সাংঘাতিক ক্রাইমের গন্ধ পাইছি। একটু একটু বুঝতে পারছি কী বলতে চাইছ।’
‘ভায়া ডাক্তারদের বিদ্যে থাকে, ‍বুদ্ধি থাকে। তারা যদি ক্রাইমে নামে, তাদের জেয়ে বড়ো ক্রিমিন্যাল আর হয় না। এখন আর কথা নয়— তামাক খাওয়া যাক।’
রাত ন-টায় অন্ধকার গ্রাস করল জীর্ণ সৌধকে। এগারোটায় একটা উজ্জ্বল আলো দেখা গেল অন্ধকারে।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠল হোমস। সংকেত এসে গেছে। ঠিক মাঝের ঘরেই আলো জ্বলছে। চলো।’
বাগানে পৌছে জুতো খুলে পা টিপে টিপে কিছুদূর যেতেই গাছের মধ্যে বিকলাঙ্গ শিশুর মতো কী-একটা সড়াৎ করে মাঠে নেমে গড়াগড়ি দিয়ে ফের সাৎ করে মিলিয়ে গেল গাছের আড়ালে। দারুণ চমকে উঠলাম আমি। সবলে আমার হাত খামচে ধরল হোমস।
তারপরেই নিঃশব্দে হেসে বললে, ‘বেবুনটা। বেবুন তো বুঝলাম, চিতাও তো আছে। ভাবতেই গা হিম হয়ে এল। ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে তবে নিশ্চিন্ত হলাম।
খড়খড়ি বন্ধ করল হোমস। নিজে বসল বিছানায়, পাশে মোমবাতি আর দেশলাই, হাতে একটা সরু বেত। আমি বসলাম চেয়ারে, হাতে রিভলভার। বাতি নিভিয়ে দিল হোমস।
অন্ধকার। কোথাও এতটুকু আলোকরশ্মি নেই। দুরের গির্জেয় পনেরো মিনিট অন্তর বাজছে ঘণ্টা। খড়খড়ির বাইরে একবার চাপা ঘর-ঘর আওয়াজ শুনলাম। অর্থাৎ চিতাবাঘটা সত্যিই টহল দিচ্ছে বাগানে।
পর্ব ৩ঃ
সেই উৎকণ্ঠা, সেই উদবেগ, সেই প্রতীক্ষা জীবনে আমি ভুলব না। রাত তিনটের ঘণ্টা বেজে যাওয়ার পর আচমকা ভেন্টিলেটরে যেন আলোর ঝিলিক দেখলাম। সেইসঙ্গে নাকে ভেসে এল পোড়া তেল আর ধাতু তেতে ওঠার গন্ধ। অর্থাৎ চোরা লণ্ঠন জ্বলছে পাশের ঘরে। হাটাচলার মৃদু শব্দও কানে ভেসে এল। তারপর আধঘণ্টা আর কোনো শব্দ নেই পোড়া গন্ধটা কিন্তু বেড়েই চলেছে। এর ঠিক পরেই একটা নতুন শব্দ শুনলাম। 
সোঁ-সোঁ করে একনাগাড়ে যেন স্টিম বেরিয়ে যাচ্ছে কেটলি থেকে। শব্দটা কানে যেতেই হোমস বিছানা থেকে ছিটকে ফস করে দেশলাই ঘষে সপাং সপাং করে বেত হাকিয়ে চলল দড়িটার ওপর। সেইসঙ্গে চেঁচাতে লাগল আতঙ্ক বিহ্বল কণ্ঠে, ‘ওয়াটসন! দেখেছ? ওয়াটসন ! দেখেছ?’ 
কী দেখব আমি? হঠাৎ আলো জ্বালানোয় চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল— কিন্তু একটা চাপা শিসের শব্দ ভেসে এসেছিল কানে। তারপরেই ওইভাবে পাগলের মতো বেত মারা। দেখেছিলাম শুধু হোমসের মুখের চেহারা। আতঙ্কে’, ঘৃণায়, বিভীষিকায় পাণ্ডুরবর্ণ সে-মুখ যেন চেনাই যায় না।
মার বন্ধ করে ভেন্টিলেটরের দিকে চেয়েছিল হোমস। আচমকা নিশীথ রাতের নৈঃশব্দ খান খান করে জাগ্রত হল একটা অতি ভয়াবহ আর্ত চিৎকার— জীবনে এমন রক্ত জমানো মরণ হাহাকার আমি শুনিনি। ক্রমশ পর্দা চড়তে লাগল চিৎকারের— আতীব্র যন্ত্রণা নিঃসীম আতঙ্ক আর অপরিসীম ক্রোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল সব শেষের বুকফাটা চিৎকারটার মধ্যে। লোমহর্ষক সেই চিৎকার শুনে নাকি গাঁয়ের সবাই বিছানায় উঠে বসেছিল— গাঁয়ের বাইরেও অনেকের ঘুম ছুটে গিয়েছিল। অবর্ণনীয় সেই চিৎকার সাপের মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে অবশ করে তুলল আমাদের চিত্ত— ফ্যালফ্যাল করে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম আমি আর হোমস। আস্তে আস্তে প্রতিধ্বনির শেষ রেশ মিলিয়ে গেল দূর হতে দূরে— আবার টুঁটি টেপা নৈঃশব্দ্য চেপে বসল নিশীথ রাতের বুকে।
বললাম রুদ্ধশ্বাসে, “এ আবার কী?’
‘সবশেষ। পিস্তল নাও, চলো ডা. রয়লটের ঘরে।’
গম্ভীর মুখে বাতি জ্বালল হোমস। করিডরে বেরিয়ে দু-বার ধাক্কা মারল দরজায়— সাড়া এল না। তখন হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ঢুকল ভেতরে— ঠিক পেছনে উদ্যত পিস্তল হাতে আমি।
দেখলাম এক অসাধারণ দৃশ্য। দেখলাম, টেবিলের ওপর জ্বলছে একটা আঁধার লণ্ঠন— শাটারটা অর্ধেক খোলা। তির্যক রশ্মিরেখা গিয়ে পড়ছে পাল্লা সিন্দুকের ওপর। টেবিলের পাশেই চেয়ারে বসে ডা. গ্রাইমসবি রয়লট। পরনে ধূসর লম্বা ড্রেসিং-গাউন, নগ্ন গোড়ালি দেখা যাচ্ছে তলার দিকে, পায়ে লাল তুর্কি চটি। বিকেল বেলা ফাঁসওলা যে-চাবুকটা দেখে অবাক হয়েছিলাম, কোলের ওপর রয়েছে সেই চাবুকখানি। চিবুক ওপরে তোলা, ভয়াবহ আড়ষ্ট চাহনি নিবদ্ধ কড়িকাঠের দিকে, কপাল ঘিরে একটা অদ্ভুত হলদে পটি। ছিট-ছিট বাদামি দাগ দেওয়া ডোরাকাটা পটি! খুব আঁট করে যেন মাথায় বেড় দিয়ে রয়েছে বিচিত্র সেই পটি। আমরা ঘরে ঢুকলাম, ডাক্তার কিন্তু নড়লেন না, কথাও বললেন না। ‘ডোরাকাটা পটি? ফুটকি দাগ দেওয়া ডোরাকাটা সেই পটি! ফিসফিস করে বললে হোমস। এক পা এগিয়েছিলাম আমি। অমনি নড়ে উঠল মাথার আশ্চর্য পাগড়ি। সরসর করে খুলতে লাগল বেড় এবং চুলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল চেপটা রুইতনের মতো একটা মাথা— ঘাড় মোটা গা-ঘিনঘিনে একটা সরীসৃপ।
চেঁচিয়ে উঠল হোমস, ‘অ্যাডার সাপ। বাদায় থাকে! ভারতবর্ষের সবচেয়ে বিষধর সরীসৃপ! ছোবল মারার দশ সেকেন্ডের মধ্যে অক্কা পেয়েছে ডাক্তার। নিজের ফাঁদেই শেষ পর্যন্ত পড়তে হয় কুচক্রকে— অন্যের বুকে ছুরি মারতে গেলে সে-ছুরি নিজের বুকে বেঁধে। যাক, এখন ডেরায় পাঠানো যাক সরীসৃপ মহাপ্রভুকে। তারপর মিস স্টোনারকে নিরাপদ জায়গায় পৌছে দিয়ে খবর দেব পুলিশকে।
ঝট করে ডাক্তারের কোল থেকে ফাঁস দেওয়া চাবুক তুলে নিয়ে হোমস অ্যাডারের গলায় ফাঁস আটকে টেনে নিয়ে গেল সিন্দুকের মধ্যে— বন্ধ করে দিল পাল্লা।
পরের দিন বাড়ি ফেরার পথে হোমস যা বললে তা এই : 'ভায়া ওয়াটসন, জিপসি আর পটির কথা শুনে গোড়া থেকেই ভুল ধারণা করেছিলাম— শুধু একটা ব্যাপার ছাড়া। ওই ভেন্টিলেটরটা চোখ খুলে দেয় আমার। জানলা দিয়ে কিছুই ঢোকা যখন সম্ভব নয়, তখন বুঝলাম ঘুলঘুলির ফুটাে দিয়ে এমন কিছুই বেরিয়ে আসে, বিছানা পর্যন্ত যাকে নামবার জন্যে ঝোলানো হয়েছে দড়িটা। ভারতবর্ষের ভয়ানক জীবজন্তু পোষার শখ আছে শুনে সন্দেহ ঘনীভূত হল। রাসায়নিক পরীক্ষায় ধরা যায় না এমন বিষ যদি শরীরে ঢোকানো যায়, মৃত্যুর কারণ ধরা পড়বে না। ছোবল দেওয়ার ছোট্ট দুটো ফুটোও অনেকের নজর এড়িয়ে যাবে। শিস দেওয়া হত সাপটকে ডেকে নেওয়ার জন্যে– দুধের লোভও দেখানো হত— কিন্তু ঘুমের ঘোরে সাপের ল্যাজে পা দিলে কামড় তো একদিন খেতেই হবে।
এই সিদ্ধান্ত মাথায় নিয়ে ঢুকলাম ডাক্তারের ঘরে। চেয়ার পরীক্ষা করলাম— দেখলাম ডাক্তার তাতে উঠে দাঁড়ায়। নইলে তো ভেন্টিলেটরের নাগাল ধরা যাবে না। ফাঁসওলা চাবুক, লোহার সিন্দুক আর দুধ দেখে কোনো সন্দেহই আর রইল না। ঝন-ঝন-ঝনাৎ আওয়াজটা আসলে লোহার সিন্দুকের ডালা বন্ধ করার আওয়াজ-- সরীসৃপকে সিন্দুকে চালান করে সিন্দুক বন্ধ করেছিল ডাক্তার। সাপের ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনেই বেত মেরে ভাগিয়ে দিলাম যার কাছ থেকে এসেছে— তারই কাছে। মার খেয়ে সামনে যাকে পেয়েছে তাকেই ছোবল মেরেছে। সুতরাং লোকে বলবে আমিই হয়তো ডা গ্রাইমসবি রয়লটের মৃত্যুর কারণ। তাতে আমার বিবেক কোনোদিন কাতর হবে না।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প: বুড়ো

নিখোঁজ

সিরিঞ্জ